প্রশাসন ক্যাডার বনাম অন্যান্য ক্যাডার বিতর্ক এবং তার সমাধান


প্রকাশের সময় : ডিসেম্বর ২৫, ২০২৪, ৬:৩৩ পূর্বাহ্ন
প্রশাসন ক্যাডার বনাম অন্যান্য ক্যাডার বিতর্ক এবং তার সমাধান

মতামত:মো: রাশিদুল হাসান

প্রভাষক রসায়ন, সরকারি মধুসূদন কলেজ, যশোর

বর্তমানে প্রশাসন ক্যাডারের সাথে অন্যান্য ক্যাডার বিশেষ করে টেকনিক্যাল ক্যাডারগুলোর দ্বন্দ্ব চরমে উঠেছে সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবনার ২টি পয়েন্ট নিয়ে। এক- উপসচিব পদে ৫০%-৫০% কোটা রাখা। দুই- স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ক্যাডারকে ক্যাডারের বাইরে রাখা।
আমি এই দুই প্রস্তাবেরই ঘোরতর বিরোধী। তার কারন ব্যাখা করলে আপনারাও বুঝতে পারবেন। কিতাবিক লেখা ও কিছু টেকনিক্যাল শব্দের মারপ্যাঁচের কারনে যাতে জনসাধারণের বুঝতে সমস্যা না হয় সেকারনে আমি সহজভাবে বিষয়টি উপস্থাপনের চেষ্টা করছি।
১। প্রথমত ক্যাডার কেন সৃষ্টি করা হয়েছে? ক্যাডার শব্দের অর্থ এক ঝাঁক মেধাবী ও চৌকস কর্মকর্তা। কোন একটি বিশেষ কর্মের মাধ্যমে দেশ ও জাতির সেবা করা, ঐ কর্মের উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন করে জনগনের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দেয়া ইত্যাদি কাজের জন্য ক্যাডার সৃষ্টি। যেমন- একজন কৃষক তার জমিতে ফসলের কি কি সমস্যা হচ্ছে অথবা জমির কি কি সমস্যা হচ্ছে অথবা আবহাওয়াগত কারনে কি কি সমস্যা হচ্ছে ইত্যাদি সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করে সেগুলোর সমাধান কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়া ও তা পর্যবেক্ষণের কাজ করবে কৃষি ক্যাডার কর্মকর্তারা। তাদের জন্য বাৎসরিক যে বাজেট প্রণয়ন করতে হবে, যে পলিসি গ্রহণ করতে হবে তা ঐ কৃষি ক্যাডার ছাড়া আর কে ভালো জানবে?
২। একজন ডাক্তার যিনি হাসপাতালে সেবা দান করে থাকেন তিনি সবসময় রোগীদের নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। সুতরাং কিভাবে রোগীদের আরও ভালো সার্ভিস দেয়া যেতে পারে সেই পলিসি তৈরীতে উনার চেয়ে ভালো আর কে জানে?
এমনভাবে বিসিএস সমবায়, বিসিএস শিক্ষা, বিসিএস তথ্য ইত্যাদি সকল ক্যাডারই একটা স্পেসিফিক কাজ দীর্ঘদিন করার ফলে তারা ঐ বিষয়ে অভিজ্ঞ ও দক্ষ হয়ে উঠেন। তাই ঐ সমস্ত কাজে তাদেরকেই প্রয়োজন।
৩। প্রত্যেকটা ক্যাডার একটা মন্ত্রণালয়ের অধীন থেকে তাদের কাজ করে। যেমন কৃষি মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, তথ্য মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইত্যাদি। তেমনি প্রশাসন ক্যাডার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এর অধীন।
একজন কৃষি ক্যাডার কর্মকর্তা দীর্ঘদিন মাঠে কাজ করার ফলে তার যে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জন হয় তা সে কৃষি বিষয়ক পলিসি তৈরি করতে সবচেয়ে ভালো কাজে লাগবে যা শিক্ষা ক্যাডার বা অন্যান্য ক্যাডার পারবে না। আবার শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তা দীর্ঘদিন ক্লাসে পড়ানোর কারনে শিক্ষার্থীদের সমস্যাগুলো, সম্ভাবনাগুলো যেভাবে চিহ্নিত করতে পারবে শিক্ষায় পলিসি তৈরিতে সেই অভিজ্ঞতাগুলো যেভাবে সে কাজে লাগাতে পারবে তা অন্য কেউই পারবে না। যেমন সৃজনশীল পদ্ধতি প্রণয়ন করা হয়েছিলো অথচ শিক্ষকদের সাথে আলোচনা বাদ রেখেই। আর এখন তো আপনারা সবাই জানেন এর ফল কি হয়েছে। একজন শিক্ষক শিক্ষা নিয়ে যতটা আন্তরিকভাবে ভাবেন তা অন্য কেউ ভাববে না এটাই স্বাভাবিক। সেকারনেই শিক্ষকদের পলিসি মেকিংয়ে আসা দরকার। একইভাবে কৃষি ক্যাডার কর্মকর্তা কৃষি ও কৃষক নিয়ে যতটা আন্তরিক অন্য কেউ ততটা আন্তরিক হবে না। তাই কৃষি ক্যাডার কর্মকর্তাকে কৃষি মন্ত্রণালয়ের পলিসি মেকিংয়ে আসা দরকার।
৪। উপসচিব থেকে শুরু করে সচিব পদ পর্যন্ত মূলত করণিক পদ। এই কাজ করার জন্য রকেট সাইন্স জানা লাগে না। বাংলা, রাস্ট্রবিজ্ঞান, ইতিহাস, পদার্থ, অর্থনীতি, হিসাব্বিজ্ঞান, CSE,EEE ইত্যাদি বিষয়ের শিক্ষার্থীরাও এই কাজগুলো পর্যাপ্ত ট্রেনিং পেলে করতে পারে এবং করছে। কিন্তু ডাক্তার হওয়া কি শুধু কয়টা ট্রেনিং পেলেই হবে? শিক্ষক কি শুধু কয়েকটি ট্রেনিং পেলেই হবে?উপসচিব থেকে সচিব পদের কাজের জন্য মাদার সাবজেক্ট ফ্যাক্ট না কিন্তু এইসব কাজগুলোর জন্য অবশ্যই মাদার সাবজেক্টগুলো একমাত্র ফ্যাক্ট। কিন্তু প্রশাসন ক্যাডার সদস্যরা শুধু এই জুজুর ভয় দেখাচ্ছে যে অন্যান্যরা উপসচিবের থেকে সচিবের কাজ করতে পারবে না!!! পুরাই হাস্যকর ব্যাপার।
৫। প্রত্যেকটা মন্ত্রণালয়ে উপসচিব থেকে সচিব পদ রয়েছে। আমরা চাচ্ছি যে প্রত্যেকটা মন্ত্রণালয়ের অফিসার পদগুলো ঐ মন্ত্রণালয়ের ক্যাডার কর্মকর্তাদেরকে দিয়ে পূরণ করতে। তাহলে প্রশাসনের কাজে প্রচুর গতি আসবে। একজন কৃষি ক্যাডার কর্মকর্তা শিক্ষা ক্যাডারের কাজ, সমস্যাগুলো সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারবে না। তাই এক ক্যাডারের কর্মকর্তা অন্য ক্যাডারের কাজে যাওয়া উচিৎও না।
সেকারনে আমাদের প্রত্যেকের দাবি কৃত্য পেশাভিত্তিক মন্ত্রণালয়। এর ফলে প্রত্যেকটা মন্ত্রণালয়ের কাজের গতি যেমন বৃদ্ধি পাবে তেমনি তার সুফল খুব সহজেই জনগনের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাবে। লাল ফিতার দৌরাত্ম্য কমবে।
৬। কিন্তু দু:খজনক বিষয় হলো প্রশাসন ক্যাডার সকল মন্ত্রণালয়ের সকল উপসচিব থেকে সচিব পর্যন্ত পদগুলো তাদের নিজদের দাবি করছে। এ যেন মামার বাড়ির আবদার!!! জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, ভূমি মন্ত্রণালয়, ক্রীড়া, খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় ইত্যাদিগুলোতে প্রশাসন ক্যাডার উপসচিব থেকে শুরু করে সচিব পর্যন্ত থাকুক। কোন সমস্যা নাই। কিন্তু অন্যান্য মন্ত্রণালয় যেখানে তাদের রেস্পেক্টিভ ক্যাডার কর্মকর্তারা আছে সেখানে কেন অন্য ক্যাডার আসবে???

“ক্যাডার যার মন্ত্রণালয় তার” বাস্তবায়ন হলে কি কি সুবিধা হবে জনগনের সেটা নিয়ে আলোচনা করি-
১। ধরুন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে শিক্ষা / প্রশাসন ক্যাডারের কেউ উপসচিব/যুগ্মসচিব/সচিব হলো। তো সচিব মহোদয়ের তো এই লাইনে কাজের পূর্ব অভিজ্ঞতা নাই। ফলে নতুন করে তার অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য কিছুদিন (২/৩ বছর) সময় লাগবে। এই কয়দিন কাজের গতি সন্দেহাতীতভাবে কমে যাবে। আবার অভিজ্ঞতা অর্জন যখন হবে তখন সে আবার অন্য মন্ত্রণালয়ে চলে যাবে। এতে জনগনের লাভটা কি হলো? কিন্তু যে যে মন্ত্রণালয়ের সে যদি ঐ মন্ত্রণালয়েই থাকে তবে তার নতুন করে অভিজ্ঞতা অর্জনের দরকার নাই। ফলে একটা ফাইল খুব দ্রুত পর্যবেক্ষন করে ছেড়ে দিতে পারে। ছোটবেলায় একটা প্রবাদ পড়েছিলাম, যে সবজান্তা শমসের সে কোন কাজেই ওস্তাদ নয়।
২। কোন রাজনৈতিক সরকার স্বৈরাচারের ভূমিকা নিতে পারবে না। আপনারা জানেন ২০১৪,২০১৮,২০২৪ সালের হাস্যকর নির্বাচনে সরকারকে কোন ক্যাডারের কর্মকর্তারা সবচেয়ে বেশী সাহায্য করেছিলো? কাদের বেগমপাড়ায় অগনিত বাড়ি আছে? পত্রিকার খবর অনুযায়ী গত সরকারের দূর্নীতির ৪০%দূর্নীতি কারা করেছিলো? মূলত সকল ক্ষমতা যখন একটি /দুটি ক্যাডারের হাতে থাকে তখন রাজনৈতিক সরকারকে ঐ একটি/দুটি মন্ত্রণালয় হাত করলেই চলে। কিন্তু যখন প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণ হবে তখন কোন রাজনৈতিক সরকারের জন্য তা করা অনেক কঠিন হয়ে পড়বে। অর্থাৎ ক্যাডার যার মন্ত্রণালয় তার করলে দূর্নীতির প্রকোপ অনেক কমে যাবে।
৩। প্রশাসন ক্যাডারের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা অনেক ব্যস্ত সময় পার করতে দেখা যায়। যার ক্রেডিট তারা নিতে চায়। কিন্তু প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণ করলে তাদের হাতে বেশী ব্যস্ত হওয়ার মত কোন কাজই থাকে না। আবার জনগনের কাছে সেবা খুব দ্রুত সময়ে পৌঁছানো সম্ভব হয়।

একারনেই উপসচিব পদে ৫০%-৫০% একটা অযৌক্তিক প্রস্তাব। যে ক্যাডারের যে মন্ত্রণালয় সে মন্ত্রণালয়ের ১০০% এক্সেস ঐ ক্যাডারের থাকতে হবে।
আবার সরকারের কোন একটি কর্মশাখার মাধ্যমে সেবা জনগনের কাছে দ্রুত ও আধুনিক উপায়ে পৌঁছাতে হলে ক্যাডার বিলুপ্তি নয় বরং ঐ ক্যাডারের হাতে ঐ মন্ত্রণালয় ছেড়ে দিতে হবে।

সুতরাং বর্তমানে উত্থাপিত সকল সমস্যার একটাই ভালো সমাধান। সেটা হলো কৃত্য পেশাভিত্তিক মন্ত্রণালয় অর্থাৎ “ক্যাডার যার মন্ত্রণালয় তার।”